সব কিছু যেন বড্ড তাড়াতাড়ি হয়ে গেল না? ঠিক বুঝতে পারছি না। সত্যি কি এই
দুর্ঘটনা হল? না কি ওরা সবাই মিথ্যে বলছে? সত্যি বলছি বিশ্বাস হচ্ছে না... একদম
না। সেই মানুষটা যে সবার মনের মানুষ হয়ে গেছে তাকে কি ভোলা যায়?
ছোটবেলা থেকে একটা সুর আমার কানে প্রায়ই বাজত, “ তানানা নারে নারে না, তানানা
নারে নারে না...” আমি গায়কের নাম জানতাম
না। কিন্তু টিভিতে খুব দেখেছি তাঁকে। আস্তে আস্তে অনেক গান শুনতাম তাঁর। কিন্তু
নামটা জানিনি, জিজ্ঞেসও করিনি। ২০১৫ সনের
কথা, আমি জী-বাংলার সা রে গা মা পা রিয়েলিটি শোটি টিভিতে দেখছিলাম। হঠাৎ করে বাবা
বলল,“ঐ যে শিল্পীকে দেখছিস,সে আমার ছোটবেলার বন্ধু।আমার বছরখানিক জুনিয়র। আমি
প্রথমে একদম বিশ্বাস করিনি,আর করবও কেন! এত্তো বড় বিখ্যাত গায়ক বাবার বন্ধু! তা তো
হতে পারে না। যাই হোক, বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত করে নিলাম। তবুও সন্দেহ অল্প ছিল, কারণ
বাবা আমার সঙ্গে ঠাট্টাও করে কখনো কখনো। বাবার থেকে নামটি জানলাম---কালিকাপ্রসাদ
ভট্টাচার্য। আমার ঠিক তারিখটি মনে পড়ছে না। কিন্তু এটা ২০১৫র সেপ্টেম্বরের কথা।
মাকুম রেলওয়ে হাইস্কুলের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে কালিকাপ্রসাদ এবং তাঁর পুরো ব্যাণ্ডকে
আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। পুরো রাত নিয়ে দোহার মাকুম রেলওয়ে হাইস্কুলের রঙ্গমঞ্চ
কাঁপিয়ে ফেলেছিল। চারিদিকে আনন্দ। হাসি আর উল্লাস যেন ছড়িয়ে পড়েছিল। আমার মনে পড়ে
অনুষ্ঠানের শেষের দিকে যখন ‘পুরোনো সেই দিনের কথা ভুলব কীরে হায়!’ সবাইকে সঙ্গে
গাইতে বলেছিল, হাজার কণ্ঠ গেয়ে উঠেছিল। আর কালিকাকাকু বলেছিল, পুরোনো দিনের বন্ধু
বাবা আর আশুজেঠুকে পেয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যে এই গানটি উৎসর্গ করছে। শুনে আমার খুব ভাল
লেগেছিল। প্রোগ্রামটি শেষ হবার পর আমি মা, বাবা আর আশুজেঠু বেকস্টেজে চলে যাই।
বাবা আর কালিকাপ্রসাদের জানি না কত বছর পরে দেখা হয়েছিল। আশুজেঠুর কথাও একই। তারা
পুরো জমিয়ে আড্ডা দিয়েছিল। বাবা তো ঘরে ফেরার নামই নিচ্ছিল না। ঠিক বারোটার সময়
আমরা সবাই একসঙ্গে তিনসুকিয়া ফিরে আসি। ওরা আমাদের বাড়ির কাছেই এক হোটেলে ছিলেন
কিনা।
সেইদিন থেকে আমি সত্যি বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম যে কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য
বাবার বন্ধু। আমি ঠিক করলাম
কালিকাপ্রসাদকে আমি কালিকাকাকু বলে ডাকব। কেন না,আমি জানি যারা আমার বাবার
থেকে ছোট তাদেরকে কাকু বলে ডাকতে হয় আর যারা বড় তাদেরকে জেঠু।
পরেরদিন সকালে বাবা কালিকাকাকু এবং দোহারের একজন সদস্য রাজীবকাকুকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল।আমাদের বাড়িতে পুরো ভিড় হয়ে গেছিল
কালিকাকাকুকে দেখার জন্য। আমি আমার কয়েকজন বান্ধবীদেরকেও আসতে বললাম। একজনও
বিশ্বাস করল না আমার কথাটা।তাইমা,সুজয় জেঠু,বনশ্রী আন্টি, আমার এক বান্ধবী তনু এবং
ওর মা,আমার গানের শিক্ষক-শিক্ষিকা অমল মুখার্জি এবং তাঁর স্ত্রী সুমি মুখার্জি এবং
আরো অনেকে কালিকাকাকুকে দেখতে এসেছিল। খুব মজা হল সেই দিনটায়,যা আমি জীবনে ভুলতে
পারব না। কালিকাকাকু যাবার আগে আমি আর আমার বান্ধবী তনু একটি লোকগান গেয়ে সবাইকে
শোনাই,“তোমায় হৃদমাঝারে রাখিব ছেড়ে দেব না।” বেলা ১১টার সময় কালিকাকাকুরা হোটেলে ফিরে যায়। কখন সে আমাদের সবার মনের
মানুষ হয়ে মুহূর্তে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল, বোঝার সময়টুকু দিল না। সহজ মনের,সেই
মানুষটা খালি রেখে গেল চোখের জল।কার থেকে ছুটে আসবে সেই মাটির গান!আরো কত গান
শোনার বাকি ছিল, আরো কত গল্প ছিল তোমার সাথে। কাকে পাশে পাবে বাঙালির আগামী
শিল্পীরা? টিভি ভেতরে বাইরে মঞ্চে সেই সব
গান বাজবে কিনা আমি জানি না, তবে আকাশে কান পাতলেই,শুনতে চাইব তোমার গান। আসামের
চা-বাগানে মনে পড়বে তোমাকে।
আমি তো গান গাই। বহুদিন ধরে বলছি গান নিয়ে পড়াশোনা করব। বাবা বলছে, কালিকার
মতো পড়, ও যা করে যেতে পারল না তুই করবি। তাঁর স্মরণে ‘উজান সাহিত্য গোষ্ঠী’
তিনসুকিয়াতে একটি সভা করল ১১ মার্চে। বাবা আমাকে বলেছিল,নতুন বাংলা ছবি ‘ভুবন
মাঝি’র জন্য কালিকাকাকু একটি সুন্দর গান লিখেছিল। সেটিই আমাকে গাইতে হবে সেই
অনুষ্ঠানে। আমি তাই গাইলাম। সেই গানেই তোমাকে আমার শ্রদ্ধা জানালাম। গানের কথা নিচে রইল। ভালো থেকো কালিকাকাকু। তোমায় হৃদমাঝারে রাখিব ছেড়ে
দেব না। 😊
~~~~০০০~~~
বাংলাদেশের ফাখরুল আরেফিন খান পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'ভূবন মাঝি' । ছবিটিতে
অভিনয় করেছেন ভারতের পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও বাংলাদেশের অর্পণা ঘোষ। ১৯৭০ সাল
থেকে ২০১৩ সালের কিছু সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ছবির গল্প সাজানো হয়েছে । ২০১৭
সালের ১ মার্চ ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সে চলচ্চিত্রটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় এবং
৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে ১৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। ছবিতে চারটি গান রয়েছে।
তার একটি এই--লিখেছেন কালিকা প্রসাদ। গেয়েছেন সপ্তর্ষি। কিন্তু দোহারের শিল্পীদের
গাওয়া একটি সংস্করণও রয়েছে। আমার গাওয়া গানের দুই সংস্করণ এখানে রইল। প্রথমটি অনুশীলন পর্বের। দ্বিতীয়টি মূল অনুষ্ঠানের। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্যে মূল অনুষ্ঠানেরটি পুরো রেকর্ড করা হয় নি।
আমি তোমারই নাম গাই
আমার নাম গাও তুমি
আমি আকাশে রোদের দেশে
ভেসে ভেসে বেড়াই
মেঘের পাহাড়ে চড়ো তুমি।
আমি তোমারই নাম গাই
আমার নাম গাও তুমি
ভালবাসা করে আশা
তোমার অতল জল
শীতল করবে মরুভূমি
জলে কেন ডাঙায় আমি
ডুবতেও রাজি আছি
যদি ভাসিয়ে তোল তুমি
আমি তোমারই নাম গাই
আমার নাম গাও তুমি
তুমি এস ফসলের ডাকে
বটের ঝুরির ফাঁকে
আর এস স্বপ্নভূমি
এই স্বপ্ন দুচোখ তুলে
জেগে দেখা যায় যদি
নয়ন তারায় বসো তুমি
আমি তোমারই নাম গাই
আমার নাম গাও তুমি
কবিতা গেল মিছিলে
মিছিল নিয়েছে চিলে
অসহায় জন্মভূমি
আজ একতারার ছিলা
তোমার স্পর্শ চায়
যদি টঙ্কার দাও তুমি
আমি তোমারই নাম গাই
আমার নাম গাও তুমি
Comments